সমাজ সংস্কার থেকে নারীমুক্তি-বাংলার নবজাগরণের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

0
1876
সমাজ সংস্কার থেকে নারীমুক্তি-বাংলার নবজাগরণের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার পরিচয় একটি শব্দের মধ্যে কখনোই বন্দি করা যাবে না।তিনি ছিলেন মুক্ত আকাশের মতো, তার ব্যাপ্তি বিশাল।তিনি একধারে যেমন ছিলেন সুলেখক, বিচক্ষন শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতের অসাধারন পন্ডিত আরেকদিকে ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের এক প্রথম সারির যোদ্ধা, সমাজ সংস্কারক, এক অগ্নি পুত্র।তাঁর ছোয়ায় বাংলা ভাষা পেয়েছিল এক নবীন দিশা, জন্ম নিল বাংলা ভাষার নতুন অক্ষর, যা হয়ে উঠলো সাধারন মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম।

উনবিংশ শতকের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগরের জন্ম হয় ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে।ঈশ্বরচন্দ্র নাস্তিক হলেও তাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভগবতী দেবী ছিলেন পরম ধার্মিক মানুষ।কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই দারিদ্রতা ছিল ঈশ্বর এবং তাঁর পরিবারের অভিন্ন সঙ্গী।ফলে পড়াশোনা করার জন্য সাধারন সুবিধাটুকু থেকেও বঞ্চিত হতে হয়েছে তাকে।

তবে জেদী বিদ্যাসাগরের কাছে দারিদ্রতা কোনো বাঁধাই ছিলো না।তিনি সংস্কৃতে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহন করেছিলেন গ্রামের একটি পাঠশালায়।কিন্তু তারপরেই তাকে সমস্ত ছেড়ে পিতার হাত ধরে ১৮২৬ সালে পাড়ি দেন কোলকাতার উদ্দেশ্যে।পায়ে হেঁটে কোলকাতায় আসার সময় পথের মাইল স্টোন-এর মাধ্যমে বিদ্যাসাগরকে সংখ্যা পরিচয় করান তাঁর পিতা।এরপর কোলকাতার বড়ো বাজারে পিতার সাথে বাস করতে শুরু করেন তিনি।কিন্তু দারিদ্রতার কারণে তাকে শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি বাড়ির কাজও করতে হতো।সারাদিন ঘরের যাবতীয় কাজ করে রাত্রে বেলায় আগামী দিনের রান্নার তেলটুকু বাঁচাবার তাগিদে রাস্তার গ্যাসের আলোয় বসে পড়াশোনা করতেন বালক বিদ্যাসাগর।

বিবাহ ও কর্মজীবনে প্রবেশ

অসম্ভব জেদ নিয়ে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে করতে ধীরে ধীরে তিনি বেদান্ত, ব্যাকরণ, সাহিত্য, সংস্কৃত সহ আরও বিভিন্ন ভাষায় অর্জন করেন অপরিসীম পান্ডিত্য।এরপর সংসারে আর্থিক সাহায্য করার তাগিদে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন এবং তাঁর সাথে পেতে থাকেন স্কলারশিপের সুবিধা।১৮৩৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃতের এক দূর্দান্ত প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি অসাধারণ পান্ডিত্য প্রদর্শন করে প্রতিযোগীতায় জয়ী হন।এরপরেই সংস্কৃতের পন্ডিতেরা তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।এই বছরেই তিনি সফলভাবে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

১৪ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহধর্মিনী দিনমনি দেবীর সাথে সংসার জীবন শুরু করেন তিনি।ঈশ্বরচন্দ্র এবং দিনমনি দেবীর একটি মাত্র পুত্র সন্তান হয়, তাঁর নাম নারায়ন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।পিতার সুযোগ্য পুত্র নারায়ন চন্দ্রও ভবিষ্যতে ‘বিদ্যারত্ন’ উপাধি লাভ করেন।

শুরু হলো এক অদম্য লড়াইয়ের পথ

১৮৪১ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত বিভাগের হেড পন্ডিত হিসাবে নিযুক্ত হন।এই স্থানে চাকুরীরত অবস্থাতেই তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন ইংরেজী এবং হিন্দী ভাষায়।এর পাঁচ বছর পর তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ত্যাগ করে সংস্কৃত কলেজে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী’ পদে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী কালে তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হিসাবে নিযুক্ত হন।সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক হওয়ার সাথে সাথেই সংস্কৃত কলেজের গোঁড়া হিন্দু নিয়ম কানুনের আমূল পরিবর্তন করেন তিনি।বাংলার সমস্ত গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আজীবন নিযুক্ত ছিলেন তিনি।

বিধবা বিবাহের পক্ষে লড়াই

তৎকালীন সময়ে নারীদের ভাগ্য ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন।সেই অন্ধকার মোচনে উদ্যোগী হন দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র।সেই সময়ে ছিল বাল্য বিবাহের প্রথা।সমাজে তখন আট বছর বয়সেই কন্যার ‘গৌরী দান’ চলছে রমরমিয়ে।পাত্র যত বয়স্কই হোক তাঁর হাতেই ছোট্ট কন্যাকে তুলে দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হচ্ছেন পিতারা।আর এই নিয়মের অমান্য করলেই কন্যার পিতার ওপর নেমে আসছে সমাজপতিদের নির্মম কোপ।ফলতই অসময়ে বিবাহের অনতিকাল পরেই বালিকা বধূদের জীবনে ঘনিয়ে আসে বৈধব্যের অন্ধকার এবং সমাজের নিষ্ঠুর কৃচ্ছসাধন।ঈশ্বরচন্দ্রের মন কেঁদে ওঠে সমাজের এই অল্পবয়সী বিধবাদের চোখের জলে।তিনি শুরু করেন বিধবা বিবাহের সপক্ষে আন্দোলন।সমাজপতিদের সাথে চলে তাঁর ধর্মের তর্ক-বিতর্ক।কিন্তু শাস্ত্রে তাঁর অপরিসীম জ্ঞানের সামনে অচিরেই হেরে যান তারা।১৮৫৬ সালে শেষ পর্যন্ত এই অপরিসীম লড়াইয়ের ফল স্বরূপ পাশ হয় ‘বিধবা-বিবাহ আইন’।এরপরেই তাঁর চেষ্টাতেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় ‘বাল্য বিবাহ’ এবং পুরুষের ‘বহু বিবাহ’ প্রথা।

শিক্ষাক্ষেত্রে আলোর দিশা-নারী শিক্ষার শুরু

মধ্যযুগের সংস্কৃত শিক্ষাকে আধুনিকতার মোড়কে সবার বোধগম্য করে প্রথম উপস্থাপন করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক থাকা কালীন তিনি সেই কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় এনেছিলেন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন।সংস্কৃত কলেজের বিদ্যার্জনের ভাষার মাধ্যম হিসাবে তিনি সংস্কৃতের সাথে সাথে ইংরাজী ও বাংলা ভাষার প্রবর্তন করেন।আগে সংস্কৃত কলেজে ছিল শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ সন্তানদের শিক্ষা অর্জনের অধিকার।শুধুমাত্র তাঁর প্রচেষ্টায় সেখানে অন্যান্য জাতির ছেলেমেয়ারাও শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেল।সংস্কৃত ভাষার প্রতি সব মানুষেরই অধিকার আছে-এই ভাবনা প্রচারের জন্য তিনি সহজ বাংলা ভাষায় লিখে ফেললেন ‘উপক্রমর্নিকা’ এবং ‘ব্যাকরণ কৌমুদি’।তাঁর সদইচ্ছায় সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার আলো।

বিদ্যাসাগর তাঁর সারা জীবন নারী মুক্তির উদ্দেশ্যেই উৎসর্গীত করেছিলেন।ফলে নারীশিক্ষার জন্যও তিনি শুরু করলেন তাঁর আন্দোলন।তিনি বুঝেছিলেন নারীদের ভাগ্যহীনতার একমাত্র কারণ হলো শিক্ষার অভাব।শিক্ষার আলোই একমাত্র পারে নারীজীবনের এই অন্ধকার ঘোচাতে।নারীদের জন্য তিনি শুরু করলেন ‘বালিকা বিদ্যালয়’।নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন বিদ্যা অর্জনের জন্য।তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন না হলেও তাঁর ডাকে সারা দিয়ে কয়েকজন বালিকাকে নিয়েই তিনি শুরু করলেন নারী শিক্ষার পথে যাত্রা।

বাংলার সূর্যের শেষের আলো

বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তান,নবজাগরণের পুরোধা বীরসিংহ গ্রামের এই অগ্নিপুত্রের জীবনের সমস্ত সংগ্রামের অন্ত ঘটে ১৯৮১ সালের ২৯শে জুলাই।সত্তর বছর বয়সে তিনি তাঁর সমস্ত যুদ্ধ থামিয়ে অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

আরও পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি ও রোমাঞ্চের এক অভুতপূর্ব মিশেল – বিভুতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply